মেয়েটার জ্বালাতনে ভাল কোনো পোষাকই পড়া
যেত না। গাল টিপে ধরে বলতো,
“কপালে কাজলের
ফোঁটা দিসনি কেন? নজর লাগবে তো!” আমি হাসতাম শুধু। কিছু বলতাম না। কত
পাগলামিই যে করতো পাগলিটা। ভীড় বাসে হয়তো ঠ্যালাঠেলি করে দুইজন উঠেছি, এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বলতো, “তোমার জন্য নিলচে তারা, শোনা না প্লীজ...”। অর্ণবের এই গানটা
ওর অসম্ভব প্রিয়। আমার আর কী করা, পাগলির
সাথে যখন গাট্টা বেঁধেছি,
বাসের মধ্যেই
গাইতে হত- তোমার জন্য নিলচে তারার একটুখানি আলো, ভোরের রঙ রাতে মিশে কালো...। আশে পাশের মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকতো। কেউ কেউ হাসতও। সে হাসুক গে। আমি আমার পাগলিটাকে হাসাতে পারলেই খুশি।
এখন এসব স্মৃতি। অনীয়ার সাথে সম্পর্কটা
ভেঙ্গে গেছে তাও প্রায় বছর খানিক আগে। ভালবাসা দিবসের দিন। একটা নীল পাঞ্জাবী
উপহার দিয়ে কোথায় যে চলে গেল, খুঁজেই
পেলাম না। তখন থেকেই আমি একা। একদম নিঃসঙ্গ সুর্যের মত
একা। মাঝে মাঝে ওর দেয়া পাঞ্জাবীটা নাকের কাছে ধরে নতুনত্বের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা
করি। পুরনো হয়ে গেছে। পুরনো পুরনো একটা গন্ধ। ঠিক সহ্য হয় না।
কাল নাকী ভালবাসা দিবস। ফেসবুক
ভালবাসায় একাকার হয়ে গেছে। গলীর মোড়ে মোড়ে লাল গোলাপের দোকান বসছে। গত একটা বছরে
ওর নাম্বারটাতে শত সহস্র মেসেজ দিয়েছি। একবারও ডেলিভারি রিপোর্ট আসেনি। মাঝে মাঝে
সব কৌতুক মনে হয়। কখনো মেসেজ দেই, “অনীয়া
আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি রে...”। আবার খানিক্ষণ
পরেই দেই, “আজ কৈ মাছের তরকারীতে বুয়া ঝাল কম
দিয়েছিল”। সব কিছু এলোমেলো। জানি এগুলো কখনো আর অনীয়ার
কাছে পৌঁছাবে না। বলবে না,
“খাবার প্যাকেট
করে নিয়ে আয়। আমি তো ঝাল কমি খাই”।
অনেক গুলো উদ্দেশ্যহীন মেসেজের মত আরও
একটা মেসেজ লিখলাম, “কাল একবার দেখা করবি?” হাজারটা মেসেজের মত এটাও গন্তব্য না
পেয়ে আটকে থাকবে আমি জানি।
কিন্তু আমার হাত, হাতে থাকা মোবাইল আর বুকটা মেসেজের
ভাইব্রেশনে ধুক ধুক করে কেঁপে উঠলো। মেসেজটা গিয়েছে! অনীয়া সিম খুলেছে! বুকের
কাঁপুনিটা তখনো ঠিক বন্ধ হয়নি। কেঁপে উঠলাম আরও একবার। অনীয়ার মেসেজ- “ক্রিসেন্ট লেক। বিকাল পাঁচটা”। সব কিছু কেমন যেন
স্বপ্ন মনে হতে লাগলো।
পুরনো গন্ধ হয়ে যাওয়া নতুন নীল
পাঞ্জাবী আর পরতে পরতে পায়ের কাছে ক্ষয়ে যাওয়া একটা জিন্সের প্যান্ট পরে বের হলাম।
ক্রিসেন্ট লেকের সিঁড়িটার পঞ্চম ধাপে এসে অনীয়া বসবে, আমি জানি।
...হুম। অনীয়া ওখানেই বসে আছে। পরনে
আমার সবচেয়ে পছন্দের সাদা জামাটা। একদম আগের মতই আছে। চোখে হালকা করে কাজল দেয়া।
আহামরী কোনো সাজ নয়। মানানসই দুরত্ব রেখে বসলাম। বললাম, ভাল আছিস? উত্তর দিল না। একমনে সিঁড়িতে দাগ কেটে
লেখা পুরনো স্মৃতিগুলো পড়ছে। এখনো অক্ষত!
বেশ অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে গেল। একসময়
আমিই বললাম, একটু হাতটা ধরি? না করে দিল। খানিক্ষন পর আবার বললাম, ধরি না একটু...। অনীয়া এবার মুখ তুলে
বললো, নীল পাঞ্জাবীটা পরে এসেছিস কেন? উত্তর ঠিক কী দেয়া উচিৎ বুঝতে না পেরে
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এই জামাটা পড়ে এসেছিস কেন?
আবারও উত্তর নেই। মাথা নিচু করে
সিঁড়িতে দাগ কাটা শব্দটা দেখছে- “ভালবাসি
অনীয়া”। বছর দুই আগে
স্কেল দিয়ে ঘষে ঘষে আমিই লিখেছিলাম। হঠাতই এক ফোঁটা পানি পড়লো ওখানে। আমার অনীয়া
কাঁদছে!
চোখের কাজল গালে লেপ্টে আছে!
এবার আর কোনো জড়তা কাজ করলো না।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ অধিকার নিয়ে কাছে টেনে নিলাম। বললাম, “এখনো ভালবাসি রে পাগলি”। এক মুহুর্ত নীরবতা। হঠাতই চোখে পানি আর মুখে হাসি
নিয়ে অনীয়া আমার গাল টিপে ধরে বললো, কপালে কাজলের ফোঁটা দিসনি কেন? নজর লাগবে তো!
কে যেন ফোন দিয়েছে। পকেটে মোবাইলের
রিংটোন বাজছে, তোমার জন্য নিলচে তারার একটু খানি আলো, ভোরের রঙ রাতে মিশে কাল। কাঠগোলাপের
সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি, আবছা
নিল তোমার লাগে ভাল...।