তোর জন্য, আমি বন্য

... রাত দু'টো বাজে। কিন্তু ঘুম আসছে না কোনো মতেই। মাত্র কয়েকদিন আগেও রাত গুলো নির্ঘুম কাটলেও, সেটার মাঝে একটা তৃপ্তি ছিল। ভালো লাগা ছিলো। কিন্তু আজকের এই রাত কেবল বেদনায় ভরা বিষাদমাখা স্মৃতি। মেঘলা- আমার জীবন-মরন, ভালোলাগা-মন্দলাগা, সব। কিন্তু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোনো কারন ছিলো না। কোনো ভুল ছিলো না। কোনো অন্যায়, অপরাধ কিছুই ছিলো না। ছিলো কেবল অকৃত্রিম ভালোবাসা। হঠাত নিজের অজান্তেই খাট থেকে নিচে নামলাম। প্যান্ট-টিশার্ট পড়াই আছে। সেজে গুজে দেখা করতে গিয়ে যখন হৃদয় ভাঙ্গা বার্তা নিয়ে ফিরে এলাম, তখন আর এগুলো চেঞ্জ করতে ইচ্ছে করেনি। মেয়ে মানুষের মত মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কিছুক্ষন কাঁদলাম। লাভ হল না। মনের আগুন নিভলো না। তবে আগুন নিভবে এবার। বেড়িয়ে পরলাম বাসা থেকে। আগুনটা যে আমাকে নিভাতেই হবে!


১।
... কলেজের প্রথম দিন। নবীন বরন আরকী। কাউকে ঠিক সেভাবে চিনি না। নতুন কলেজ, নতুন মানুষ। এদের মাঝে একজন কেবল আমার চেনা। যদিও আগে কখনো দেখিনি, তারপরেও চেনা। এই কিছুক্ষন আগে, আমি যখন কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন মেয়েটা রিক্সা নিয়ে এসে কলেজের সামনে নামলো। সাদা একটা জামা পড়েছে। কপাল্কে ছোট্ট একটা কালো টিপ। চোখে হালকা করে কাজল টেনে দেয়া। আহামরী নয় তবে মিষ্টি চেহারা। সাদাতে অসাধারন লাগছে। মনের অজান্তেই অনেক্ষন ধরে তাকিয়ে ছিলাম। কী যেন ভাবনা খেলছে মনের মাঝে। কী যেনো! হঠাত ওড় ডাকে বাস্তবে ফিরলাম, "এই যে ভাইয়া, একটু হেল্প করেন না..." হুম হেল্প তো করবোই। এত মায়াবী একটা মেয়েকে যদি হেল্প না করি, করবো কাকে! কিন্তু কি হেল্প? ওর রিক্সা ভাড়া খুচড়ো নেই। তিরিশ টাকার ভাড়া মেটাতে ৫০০টাকা দিয়েছে বলে রিক্সাওয়ালা একটূ কথা শুনাচ্ছে মেয়েটাকে। আমাকে বলেছিলো ৫০০টাক্লা খুচরো করে দিতে কিন্তু আমি ভাড়াটাই দিয়ে দিলাম। একটু কেমন কেমন চাহনী আমার দিকে দিয়ে আর তেমন আপত্তি করলো না মেয়েটা।

হাটছি দুজনে। ওর নামা জানা হল। মেঘলা। ভারী সুন্দর নাম। চারপাশের আবহাওয়ার সাথে সেদিন নামটা বেশ মিলে গিয়েছিলো। সেদিনই প্রথম আমার মনে হয়েছিলো, শুভ না হয়ে আমার নাম আকাশ হল না কেনো? মেঘলা আকাশে তাহলে এক ঝাক স্বপ্নের পাখী ভেসে বেড়াতে পারতো। 

২।
... একটা বছর পার করে ফেলেছি কলেজে। কলেজের সব কিছুই আগের মতই আছে। মোটা কাবিল এখনো রিয়ার পিছনে ঘুড়ে বেড়ায়। কিন্তু পাত্তা পায় না।  সিদ্ধার্থ এখন পর্যন্তও ইংরেজিতে পাশ করতে পারেনি। ভিপি স্যার এখনো হাটতে হাটতে যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলেন। পরিবর্তন এসেছে কেবল আমার আর মেঘলার সম্পর্কের মাঝে। বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে আরো বেশী কিছু। ও সায়েন্সের স্টুডেন্ট আর আমি ব্যাবসায় শিক্ষার। একসাথে ক্লাস করা হয় না তেমন। কেবল সপ্তাহে দুই একদিন বাংলা আর ইংরেজী ক্লাসটা। এতে মন ভরে না। দুইজন লাইব্রেরীতে গিয়ে মুখোমুখী বসি। ওর মুখের সামনে থাকে রসায়ন বই আর আমার ফিন্যান্স। এই কেবল তিরিশ সেকেন্ড পরপর বইটা নিচে নামিয়ে দুইজন দুইজনের দিকে তাকাই,  ও একটা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে আবার বই উচু করে। আমি তাকিয়ে থাকি। আচ্ছা, মেয়েদের হাসি এত মায়াবী হয় কেনো? 

৩।
... আজ আমি মেঘলাকে প্রোপোজ করবো। কলেজ জীবন প্রায়ই শেষের দিকে। এখন না করলে আর করাই হবে না। কোত্থেকে কোন ভবঘুড়ে রাজপুত্র এসে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আমার স্বপ্নের রাজকন্যাকে নিয়ে যাবে, বুঝতেই পারবো না। মেঘলা আসছে। আজকেও সেই সাদা জাআটাই পড়েছে। কপালে ছোট্ট কালো টিপ।

-মেঘলা,
- কিছু বলবে শুভ?
- হুম, একটু এদিকে আস। 

ক্যান্টিনের পাশের কড়ই গাছটার নিচে আমি আর ও গিয়ে দাড়ালাম। মনে হল ও কাপছে। কোনো এক অজানা আশঙ্কায়। অথবা জানা আশঙ্কাতেই! জীবনে প্রথম বার হাটু গেরে কারো সামনে বসলাম। হাতে আমার ছাদে লাগানো সদ্য ফোটা লাল গোলাপ। কিছুদিন আগে গাছটা কেনো যেন কিনেছিলাম! 

মেঘলা, সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে...একদম প্রথম দিন থেকে, আমি এক মোহের মাঝে আছি মেঘলা। কী করছি,না করছি- কিছুই বুঝতে পারছি আ। মনের মাঝে কেবল তোমারই ছবি আঁকা। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, মেঘলা...
সাদামাটা প্রোপোজ। কিন্তু মেঘলা মিটিমিটি হাসছে। কাপছে না আর। গোলাপটা দিতে গিয়ে দেখলাম, এত শক্ত করে ডান্টিটা ধরেছি, আর একটু হলেই গলে যেত। প্রোপোজ করার সময় কেনো যেনো শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেটার প্রভাব গোলাপটার উপরে পরেছে। মেঘলা কিছু না বলে গোলাপটা একবার দেখলো। মিষ্টি করে একবার পাগল বলে চলে গেলো। ভালোবাসার মানুশের পাগল ডাকটাও এত ভালো লাগে! 

৪।
... মেঘলা এখন আমার স্বয়নে স্বপনে সবখানে। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সব থেকে সুখী দুজন মানুষ আমরা। কলেজ মিস দিয়ে যখন ক্রীসেন্ট লেকে দুজনে পিঠে পিঠ মিলিয়ে বসে থাকি, সেটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব থেকে আনন্দের মুহুর্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ৭০০কোটি মানুষের মাঝে আমরাই সফল জুটি। আমাদের সম্পর্ক কখনো ভাঙ্গবেই না । এতো ভালো বাসলে কোনো সম্পর্ক ভাঙ্গে নাকী! 
    কিন্তু আবেগ আর বাস্তবতা দুটো দুই মেরুর। যখন আবেগ সাথে থাকে তখন বাস্ত চিন্তা মাথায় আসে না। আর বাস্তবতা মেনে নিলে তাকে আবেগ স্পর্শ করে না। কোত্থেকে যেন আমাদের সম্পর্কে বাস্তবতা হানা দিলো। গত বেশ কয়েকদিন ধরেই হটাত করে মেঘলার শুভ বুদ্ধি উদয় হয়েছে। সামএ এইচ.এস.সি। এখনো যদি এসব সম্পর্কের মায়াজালে আটকে থাকে, তাহলে পরীক্ষাটা যদি খারাপ হয়। ক্লাস ওয়ান থেকে এ পর্যন্ত টানা এক রোল করা মেয়েটা যদি পরীক্ষাটায় খারাপ করে বসে! সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, সেটা হল, "আমাদের ভবিষ্যৎ কী!" আমি বুঝি না, ভবিষ্যতের চিন্তা এখন করে লাভ কী! সেটা না হয় পড়েই দেখা যাবে। কিন্তু মেঘলা বুঝে। আরো পরিস্কার করে বললে, এই কয়েকদিন ধরে বুঝতে শুরু করেছে। 

৫।
... মেঘলা হঠাত করে ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন হয়ে গেলো। টেনেটুনে পাশ করা ছেলেটার সাথে নাকী ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তারপর? তারপর আজ... রাত দু'টো বাজে। কিন্তু ঘুম আসছে না কোনো মতেই। মাত্র কয়েকদিন আগেও রাত গুলো নির্ঘুম কাটলেও, সেটার মাঝে একটা তৃপ্তি ছিল। ভালো লাগা ছিলো। কিন্তু আজকের এই রাত কেবল বেদনায় ভরা বিষাদমাখা স্মৃতি। মেঘলা- আমার জীবন-মরন, ভালোলাগা-মন্দলাগা, সব। কিন্তু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোনো কারন ছিলো না। কোনো ভুল ছিলো না। কোনো অন্যায়, অপরাধ কিছুই ছিলো না। ছিলো কেবল অকৃত্রিম ভালোবাসা। হঠাত নিজের অজান্তেই খাট থেকে নিচে নামলাম। প্যান্ট-টিশার্ট পড়াই আছে। সেজে গুজে দেখা করতে গিয়ে যখন হৃদয় ভাঙ্গা বার্তা নিয়ে ফিরে এলাম, তখন আর এগুলো চেঞ্জ করতে ইচ্ছে করেনি। মেয়ে মানুষের মত মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কিছুক্ষন কাঁদলাম। লাভ হল না। মনের আগুন নিভলো না। তবে আগুন নিভবে এবার। বেড়িয়ে পরলাম বাসা থেকে। আগুনটা যে আমাকে নিভাতেই হবে!

৬।  
...এত রাতে রহমত চাচার দোকান খোলা থাকার কথা না। তাই আমি গিয়ে তাকে ডেকে তুললাম। বেচারার ঘুম ভাঙ্গায় বেশ বিরক্তই হল। কিন্তু যখন একটা শার্প ব্লেড চাইলাম, তখন গেলো খেপে! এত রাতে কেউ দোকানদারের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তিন টাকার ব্লেড কেনে! আমি ঠান্ডা চেহারায় টাকা মিটিয়ে হাটতে শুরু করলাম। এসব রাগটাগ এখন আমাকে স্পর্শ করবে না। মনের আগুনটা নেভাতে হবে এখন আমাকে। এই গলি, অই গলি, মেইন রোড- সব মিলিয়ে মেঘলার বাসায় পৌঁছাতে ঘণ্টা খানেক সময় লাগলো। রাস্তার সাথেই দুইতালার ফ্ল্যাটে ওরা থাকে। এত রাতে নিচে ডাকলে আসবে না। কিন্তু আমাকে যেভাবেই হোক ওকে নিচে আনুতেই হবে। ফোন দিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র একবার রিং হতেই ও একদম নির্ঘুম কন্ঠে হ্যালো বললো। তাহলে কি ও যেগেই ছিলো? ও নিজেও কি আমার মত নির্ঘুম রাত পার করছে!
      অনেক কাকুতি মিনুতি, শেষবার দেখা করার অনুরোধ আর মনে হয় মনের মধ্যকার সামান্য একটু ভালোবাসা মেঘলাকে নিচে নামিয়ে আনলো। ও এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কথা বলছি না। কেবল এক ভাবে আমার ভালোবাসার মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই কি সেই মেঘলা, যে আমাকে কথা দিয়েছিলো, কোনোদিন ছেড়ে যাবে না!এই কি সেই, যে নিজের হাত কেটে আমার নাম লিখেছিলো! অনেক রক্ত বের হয়েছিলো সেদিন ওর হাত থেকে। রক্ত আজও বের হবে। সেদিনের থেকে বেশী। অনেক অনেক অনেক বেশী...

৭।
...অনেকক্ষন দৌড়ানর পর একটা ফাকা গলিতে এসে বসেছি। পাশে খোলা ডাস্টবিন। কিন্তু গন্ধটা নাকে আসছে না কেনো যেন! আচ্ছা, সামান্য একটা ব্লেড দিয়েও একটা মানুষের গলা কেটে ফেলা যায়! একটু শুধু গোঙ্গানোর মত শব্দ হয়। তারপরে সব  শেষ! শত প্রমিজ, শত বিশ্বাস আর বিশ্বাস ঘাতকতা-সব এক নিমিষেই শেষ। সত্যিই মেঘলা, তোর জন্য আজ আমি বন্য... একদম বন্য!