আমার একাল সেকালঃ পার্থক্য কয়েকটা বছর

মানুষ পরতে পরতে পরিবর্তনের সাথে থাকে। আজ কালো ভাল লাগে তো কাল সাদা। আজ এটা করে তো কাল ওটা। মাত্র কয়েকটা বছর আগেও সব কিছু কত স্বাভাবিক ছিলো। মায়ের হাতে মার খাওয়া, আব্বুর ভয়ে পড়তে বসা, ভাইয়ার ভয়ে স্কুলে ঠিকঠাক যাওয়া। আর এখন? একটু ব্যাখ্যা করি...

সেকালঃ এককথায় দুরন্ত বলতে যা বুঝায়, তাই ছিলাম। দুই কথায়, শয়তান দুরন্ত। বাড়ির সাথে লাগোয়া ক্যানেল আছে। সারাদিন ক্যানেলে ক্যানেলে থাকতাম। গামছা দিয়ে মাছ ধরতাম। কাঁদা পানিতে দাপাদাপি করতাম। মা কলমি গাছের ডাল নিয়ে ক্যানেলের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি উঠলেই ঝুম মাইর দেয়া হবে। আমি উঠতাম না। একঘন্টা, দুইঘন্টা, তিনঘণ্টা...পাচ ঘন্টা। মা বিরক্ত হয়ে চলে যেতো। কিন্তু আমি বিরক্ত হতাম না। মহা আনন্দে গামছা দিয়ে পুটি মাছ ধরতাম। ও, আব্বুর লুঙ্গি ভাজ দিয়ে পড়তাম। লুঙ্গি পড়লে একটা বড় বড় ভাব চলে আসতো।  একদিন, গরমের দিন। ক্লাস থ্রী কি ফোরে পড়ি।

 দুপুর বেলা আম্মু আইসক্রিম কিনতে পাঠিয়েছে। আমি দোকানে যাওয়ার পথে দেখলাম, ক্যানেলে একঝাক পুটি মাছ! পানি কম, তাই দেখা যাচ্ছে। কিসের আইসক্রিম, কিসের কী! মাছ ধরায় নেমে গেলাম। অনেক মাছ হল। মনে মনে ভাবছি, মা এতো মাছ দেখে কত খুশি হবে! কিন্তু সেদিন যে আমার পিঠে কতগুলো কলমির ডাল ভাঙ্গা হয়েছিলো, মনে করতে পারছি না। 
আরেকটু বড় হলাম। একটু ভারত্ব আসলো। এখন আর ক্যানেল এর কাঁদা পানিতে দাপাদাপি করি না। এখন নেশা হয়ে গেলো 'মেকারি' করা। তাতাল, রাঙ্গতা, ছোট ছোট বাল্ব, মটর, ব্যাটারি নিয়ে ইঞ্জিয়ারিং করা শুরু করলাম। টেবিলের ড্রয়ার ভর্তি এসব সরঞ্জাম। উল্লেখ্য, ছোট বোনের খেলনা গাড়ি ভেঙ্গে মটর, আব্বুর টর্স ভেঙ্গে বাল্ব,ব্যাটারি যোগার করে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং চলতো। ছোট ছোট ফ্যান বানাতাম, সাইকেলে হোন্ডার মত হেডলাইট লাগাতাম। মা মাঝে মাঝে ধরে ঝুম মাইর দিতো। মাঝে মাঝে প্রশংসা করতো। ছেলে তার ইঞ্জিনিয়ার হবে! (ছেলে এখন বিজনেস স্টাডিজে পড়ে। ছেলে নাকি ব্যাবসা করবে)
তারপরে...তারপরে একটু একটু পাখা গজানো শুরু হল। এইটে পড়ি তখন। আমি এপর্যন্ত আব্বুর হাতে একদিন মার খেয়েছি। এক ছেলেকে মেরে মুখ ফাটায়ে দেয়ার জন্য। এইটের বছরটা মারামারি করে কাটলো। জেএসসিতে খেলাম বিশাল এক ধরা! স্টুডেন্ট খুব বেশী ভালো না তবে খারাপও না। প্লাস যে মিস যাবে সেতা কল্পনা করিনি। অঙ্কে এ গ্রেড আসলো। বাশ খেয়ে গেলাম। এবং তখন থেকে শুরু হল নতুন একটা জীবনের... সেটা একাল...

একালঃ জেদ করে ঢাকায় চলে আসলাম। বাবা মা কেউ এত ছোট বয়সে ঢাকায় পাঠাবে না। কিন্তু আমার এককথা, ঢাকার স্কুলে ভর্তি না করলে পড়াশোনাই করবো না। এই কথাটা আমার লাইফে সব থেকে বেশিবার বলা কথা। ঢাকায় এসে বড় ভাইয়ার হলে থাকলাম প্রথম দুই মাস। ভর্তি হলাম মোটামুটি একটা স্কুলে। কিন্তু হলে বেশীদিন থাকতে মন সায় দিলো না। স্বাধীন হওয়ার জন্য ঢাকায় আসা। কিন্তু এখানে থাকলে তো স্বাধীন হতে পারবো না। চলে গেলাম মেস লাইফে। প্রথম কয়েকদিন খুব খুশি! কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পড় থেকে কান্নাকাটি শুরু হল। বাথরুমে গিয়ে কাঁদি। তবে ক্লাস নাইনের প্রথম মাস ছয়েক পড়াশোনা করেছি অনেক। রেজাল্ট ভালো ছিলো। রোল হল তিন। তারপরে এই যে কান্নাকাটি, একাকিত্ব কাটানর জন্য নিজের হাতে গড়া একটা সংগঠনে জরায়ে গেলাম, এটা আমার লাইফের ২য় ভুল। সংগঠনের প্রতি ব্যাস্ততা বাড়লো। পরাশোনার প্রতি ব্যাস্ততা কমলো। আর সংগঠনের একটা বিশেষ মানুষের প্রতি এতই ব্যাস্ত হয়ে গেলাম, দুনিয়া একদিকে, আমি একদিকে। দিন যায়, রাত যায়, ক্লাস যায়, এক্সাম যায়, ডোন্ট কেয়ার। পৃথিবীটা কত সুন্দর! কত ভালোবাসি! কীসের পড়াশোনা! লাভ কী! 
আবেগ নিয়ে কি আর বেশী দিন চলা যায়। বছর খানিক এভাবে কাটল। মানুষটা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে গেল। কয়েকদিন সেই রকম কান্নাকাটি। তারপরে আস্তে আস্তে সব ঠিক... একটু একটু ভাল মনে হয় হয়ে যাচ্ছি। একটু একটু পড়াশোনা ধরছি। সব থেকে বড় কথা, একটা শিক্ষা হয়েছে। যেটা আমার দরকার ছিল। আর সেকাল আর একালের মাঝে পরিবর্তন হল, আগে দশটার মাঝে ঘুমিয়ে যেতাম। এখন রাত কোনদিক দিয়ে যায়, কিছুই টের পাই না। তিনটা চারটার আগে ঘুমানোই হয় না। বাড়িতে এসে অবশ্য বেশীরভাগ সময়ই বাড়িতে থাকি। বন্ধু বান্ধব যা কিছু আছে, ওদেরও ইদানিং সময় কম দেয়া হয়। কেমন যেন নিজের মাঝে ঢুকে গেছি। কেমন যেন সবকিছু... পৃথিবীতে কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী না, সবই ক্ষনস্থায়ী... সামান্য কিছু সময়ের জন্য। হোক সেটা সুখ, অথবা দুঃখ!